মাওলানা মাহফুজুল হক ( Mahfujul Haque ), মাওলানা মামুনুল হক ( Mamunul Haque ), উভয়ের পরিবারবর্গ, ছাত্রবৃন্দ ও দলীয় লোকজন কর্তৃক ০৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা ( Jamia Rahmania Arabia জবরদখলের প্রতিবাদ ও প্রতিকার প্রসঙ্গে আয়োজিত
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ!
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
শুরুতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করছি-
(ক) ঢাকা মহানগরীর মুহাম্মদপুর থানাধীন ঐতিহাসিক সাত মসজিদের কোলঘেঁষে অবস্থিত জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা একটি রাজনীতিমুক্ত খালেছ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এখানে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী পবিত্র কুরআন ও হাদীস শিক্ষা লাভ করছে।
(খ) মাদরাসাটি ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে মরহুম হাজী মোহাম্মদ আলী ও মরহুম হাজী মোঃ নূর হোসেন কর্তৃক রেজিস্টার্ড ওয়াকফ দলিল দ্বারা ওয়াকফকৃত জমির উপর প্রতিষ্ঠিত।
(গ) ওয়াকফকৃত উক্ত সম্পত্তি জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসার বরাবরে সরকারের ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত, যার রেজিস্ট্রেশন নং-১৯৫৮৮।
(ঘ) ওয়াকফ দলিলের শর্ত অনুযায়ী এই ওয়াকফকৃত সম্পত্তি জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ার পরিচালনা কমিটি দ্বারা পরিচালিত। বর্তমান পরিচালনা কমিটি প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালনা কমিটির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নবায়নকৃত এবং ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমোদিত।
(ঙ) অনুমোদিত পরিচালনা কমিটি নিয়মিতভাবে ওয়াকফ প্রশাসন কর্তৃক ধার্যকৃত ফি পরিশোধ করে আসছে এবং নিয়মিতভাবে ৩ বৎসর অন্তর অন্তর কমিটি অনুমোদন ও তালিকাভুক্ত করে আসছে। সর্বশেষ ওয়াকফ প্রশাসন বিগত ২১ মে ২০২৪ তারিখে ২১ সদস্য বিশিষ্ট এই পরিচালনা কমিটিকে আগামী ৩ (তিন) বৎসরের জন্য অনুমোদন প্রদান করেন।
(চ) উক্ত ওয়াকফকৃত সম্পত্তিতে অবস্থিত ৫ তলা ভবনটি মাদরাসার পরিচালনা কমিটি ও সাধারণ জনগণের আর্থিক সহযোগিতায় নির্মিত। সুতরাং এটি কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি নয় যে, এখানে মিরাসী নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
(ছ) জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসাটির গঠনতন্ত্র জয়েন্ট স্টক কোম্পানী থেকে অনুমোদিত, যার নিবন্ধন নং- ১২২৯(৪০)৮৮।
(জ) জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসাটির নাম এবং মনোগ্রামও ট্রেডমার্কস-এ নিবন্ধনকৃত।
প্রিয় সাংবাদিক ভাইয়েরা!
গত প্রায় পনেরটি বছর আমরা একটা জটিল সময় পার করেছি। আমাদের উপর চেপে বসা ফ্যাসিবাদের জাঁতাকল এ দেশের আপামর জনগণকে অব্যাহতভাবে নিষ্পেষণ করে যাচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে জেগে ওঠা সকল কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে গত জুলাই-আগস্টে বিস্ফোরণ ঘটেছিল মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব ঐক্য প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ববাসী। এই বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল ফ্যাসিবাদী রেজিমের ক্ষমতার মসনদ। মাকড়সার জালের মত ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাদের সাজানো সব কূটকৌশল।
উলামায়ে কেরাম হলেন জাতির জাগ্রত বিবেক। তাদের কণ্ঠস্বরও বারে বারে জেগে উঠেছিল এই ফ্যাসিবাদী রেজিমের বিরুদ্ধে। গত পাঁচই আগস্ট-পূর্ব আন্দোলনেও থেমে থাকেননি জাতির এই জাগ্রত সত্তাগুলো। জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ারও ছিল এই আন্দোলনে অব্যাহত অংশগ্রহণ। পুরো আন্দোলনের সময়টিতে জামি‘আর ছাত্র-শিক্ষকগণ ময়দানে নিজেদের উপস্থিতি বজায় রেখেছেন। অব্যাহতভাবে শতশত বরং হাজারো লিটার পানি সরবাহের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই জামি‘আ। ফ্যাসিবাদের নৃশংস আক্রমণে গুলিবিদ্ধ বহু আহতকে আশ্রয় ও সেবা দেওয়া হয়েছে জামি‘আর ভবনে। জামি‘আর স্টাফদের কেউ কেউ নিজেরাও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আন্দোলনকারীদের সুবিধার্থে খুলে দেওয়া হয়েছিল জামি‘আর নিয়ন্ত্রিত হাউজিংয়ের গেট। সর্বোপরি অব্যাহত দুআ ও রোনাজারীর মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে সদা মুনাজাতে ব্যাপ্ত ছিল তাবৎ আলেম-তালেবে ইলমগণ।
এভাবে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গত পাঁচই আগস্টে বাংলাদেশ লাভ করে তার দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এদিন ছিল পুরো জাতির আনন্দের দিন। এক দীর্ঘ বেদনার পর উচ্ছ্বাসের স্রোতে এই দিনে প্লাবিত হয়েছিল ঢাকার সব সড়ক-মহাসড়ক। কিন্তু কে জানত মুক্তির এই আনন্দের ক্ষণকে কালিমালিপ্ত করবে বেদনার এক তীব্র ঝাপ্টা!
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
গত ০৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বিকেল ৩ ঘটিকার পর জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসায় অবস্থানরত ছাত্রদের বড় একটি অংশ আনন্দ-মিছিলে অংশগ্রহণ করতে মাদরাসা থেকে বের হয়। গণেস্রোত তখন গণভবনের দিকে। কিন্তু কিন্তু এর অন্তরালে অকল্পনীয়ভাবে সুযোগ সন্ধানীদের আরেকটি স্রোত ছিল জামি‘আ রাহমানিয়ার ভবনমুখী। আনন্দমিছিলে অংশগ্রহণের সুবাদে মাদরাসায় তখন ছাত্র উপস্থিতি সীমিত। এই সুযোগে চরম দুঃখজনক ও নিন্দনীয় ঘটনাটি ঘটে যায়। মরহুম শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর পুত্র- মাওলানা মাহফুজুল হক ও মাওলানা মামুনুল হকের সহোদর ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, তাদের দলীয় লোকজন, অনুসারীবৃন্দ এবং মাওলানা মাহফুজুল হকের পরিচালিত বছিলায় নদীর তীরে অবস্থিত আজিজিয়া মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ এবং আরও কিছু ভাড়াটিয়া গুণ্ডাপাণ্ডা ব্যাপক ভাংচুর চালিয়ে সম্পূর্ণ অন্যায় ও অবৈধভাবে মাদরাসায় প্রবেশ করে মাদরাসাটি দখল করে নেয়। এ সময় অবৈধ দখলদাররা মাদরাসায় উপস্থিত প্রিন্সিপ্যাল (যিনি জামি‘আর পরিচালনা কমিটিরও সদস্য বটে), ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ও সিনিয়র শিক্ষকগণকে হেনস্থা করে জোরপূর্বক বের করে দেয়, ভেতরে উপস্থিত ছাত্রদের অনেককে মারধর করে বের করে দেয় এবং যারা আনন্দ মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল তাদেরকেও তারা আর ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দেয়নি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, নিজের ভাই-ভাতিজা-ভাগিনাদের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী কায়দায় এই জবরদখল চলাকালীন মাওলানা মামুনুল হক বঙ্গভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনলাইন মিডিয়ায় দেশবাসীকে লক্ষ্য করে সেই ‘ঘোলাটে পরিস্থিতিতে অরাজকতার সুযোগ নিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ না-করা’র উপদেশ দিচ্ছিলেন! অতঃপর যেন এই অবৈধ দখল উদযাপন করার জন্য এবং দখলদারদের বাহবা দেওয়ার জন্য সেই ৫ আগস্ট রাত এগারোটার দিকে তিনি নিজ ভাই-ভাতিজা-ভাগিনাদের দ্বারা দখলকৃত জামি‘আ রাহমানিয়ায় ঢোকেন এবং জবরদখল উদযাপন শেষে গভীর রাতে তিনি পুনরায় ফেসবুক লাইভে এসে দেশবাসীকে ‘শান্ত থাকার, দায়িত্বশীল হওয়ার এবং প্রতিশোধ পরায়ণ না-হওয়া’র উপদেশ দেন!!!
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
এই নির্মম দখলকাণ্ডের ঘটনার রহস্য বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসাটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এর পরিচালনার সকল দায়দায়িত্ব তার পরিচালনা পরিষদের উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল এবং মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিচালনা পরিষদের মাধ্যমে সুন্দর ও সুচারুরূপে পরিচালিত হয়ে আসছিল। মরহুম শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেব রহ. জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসাটির শুরুলগ্ন থেকেই এই মাদরাসার শাইখুল হাদীস (হাদীস পাঠদানের প্রধান শিক্ষক) হিসেবে এবং মাদরাসার পরিচালনা পরিষদে একজন সদস্য (শাইখ) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বিগত ১১/০৯/১৯৯২ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত পরিচালনা কমিটির ৪৯নং অধিবেশনে মাদরাসার ২য় প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আলী আসগর সাহেব পদত্যাগ করলে তাঁর স্থলে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-কে প্রিন্সিপ্যাল নিযুক্ত করা হয়।
উল্লেখ্য যে, জামি‘আর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সর্বসম্মত অন্যতম একটি মূলনীতি ছিল, এই প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে। কিন্তু মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে নিয়োগ লাভের পর একটা পর্যায়ে তাঁর দ্বারা এই সর্বসম্মত মূলনীতিটি লঙ্ঘিত হতে থাকে এবং ছাত্রদেরকে তাঁর নিজ দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা শুরু হয়। এই প্রেক্ষিতে বিগত ০১/০৮/১৯৯৯ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত ৮৯নং অধিবেশনে তিনি স্বেচ্ছায় প্রিন্সিপ্যাল পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং শুধু ‘শাইখ’ হিসেবে দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পারিবারিক, দলীয় এবং অনুগত কিছু লোকের প্ররোচনায় একাধিকবার পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা এবং বিশৃঙ্খলার কারণে বিগত ০২/০৭/২০০০ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত ১০০তম অধিবেশনে তাঁকে মাদরাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং বিষয়টির চূড়ান্ত ও সুন্দরতম ফয়সালার দায়িত্ব হাটহাজারী মাদরাসার তৎকালীন মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফী রহ., বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মুফতী আব্দুর রহমান রহ., বেফাকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আল্লামা নুরুদ্দীন গহরপুরী রহ. ও বারিধারা মাদরাসার তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.-সহ দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের দ্বারা গঠিত ‘মজলিসে শূরা’র ওপর ন্যস্ত করা হয়। উক্ত মজলিসে শূরার ১৩/০৮/২০০০ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত ৩য় অধিবেশনে আল্লামা আজিজুল হক রহ. নিজেই জামি‘আ রাহমানিয়ায় ফিরে না-আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন এবং এই প্রেক্ষিতে মজলিসে শূরাও তাঁর সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে নেন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, ২০০১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের কিছুদিন পর মজলিসে শূরার অধিবেশনে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর জামি‘আ রাহমানিয়ায় ফিরে না-আসার মতের ভিত্তিতে গৃহিত সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে বিগত ৩ নভেম্বর ২০০১ খ্রি. তারিখে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর পুত্রা মুফতী শহীদুল ইসলাম, পরিবারের সদস্যগণ, তাঁর দলীয় লোকজন এবং সন্ত্রাসীরা লাঠি-সোটা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এবং বোমাবাজি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে মাদরাসাটি জবরদখল করে নেয়। এ সময় তারা মাদরাসার জমি ওয়াকফকারী হাজী মোঃ নূর হোসেনকে মারধোর করে গুরুতর জখম করে এবং মাদরাসায় অবস্থানকারী ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দ ও পরিচালনা কমিটির সদস্যদেরকে হেনস্থা করে মাদরাসা হতে জোরপূর্বক বের করে দেয়।
উল্লেখ্য, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-কে জামি‘আ রাহমানিয়ায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০০১ সালের সেই জবরদখলটি আসরের আগ থেকে শুরু হয়ে রাত প্রায় ১১ ঘটিকা পর্যন্ত সংঘটিত হয় এবং দখলদাররা জবরদখল শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর বাদ মাগরিব শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-কে মাদরাসায় নিয়ে আসে এবং এই রাতেই তাঁকে সভার মধ্যমণি বানিয়ে তাঁরই মাধ্যমে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে জবরদখলটি উদযাপন করায় এবং কুরআনের আয়াত ও নানা ঘটনা বর্ণনা করে শাইখুল হাদীস সাহেব রহ. নিজেও এই জবরদখলকে ফাতহে মুবীন (সুস্পষ্ট বিজয়) ঘোষণা করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তাছাড়া জবরদখলের দিন রাতেই অর্থাৎ ৩ নভেম্বর ২০০১ তারিখে তিনি বৈধ পরিচালনা কমিটিকে অগ্রাহ্য করে জনৈক মাও: আব্দুল মালেককে আহবায়ক করে একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করেন এবং পরবর্তীকালে ২৭ মার্চ ২০০২ সালে ওয়াকফ প্রসাশনের নিকট নিজেকে পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও মুতাওয়াল্লী দাবী করে তালিকাভুক্তির আবেদন দাখিল করেন। ফলে সঙ্গত কারণেই বৈধ পরিচালনা কমিটি উল্লিখিত জবরদখল সংক্রান্ত মামলাগুলোতে তাঁকেই বিবাদী বানিয়েছিল।
প্রিয় সাংবাদিক ভাইয়েরা!
৩ নভেম্বর ২০০১ সালে সংঘটিত সেই জবরদখলের প্রতিকারের জন্য মাদরাসার পরিচালনা কমিটি হানাহানির পথ পরিহার করে আইনি লড়াইয়ের পথ অবলম্বন করে। প্রথমত জামি‘আর পরিচালনা পরিষদ মাননীয় আদালতের নিকট শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. কর্তৃক ৩রা নভেম্বর ২০০১ খ্রি. তারিখে ঘোষিত অবৈধ আহবায়ক কমিটির কার্যক্রমের উপর ইনজাংশন প্রার্থনা করে। (মামলা নং ৪১০/২০০১)। মাননীয় আদালত প্রথম আদেশেই উক্ত অবৈধ আহবায়ক কমিটির উপর ইনজাংশন জারি করেন। পরবর্তী সময়ে মামলাটি হাইকোর্টে যায়। (মামলা নং ৮৩৬/২০১১)। মাননীয় হাইকোর্ট রায়ে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, ‘শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক কর্তৃক ঘোষিত আহবায়ক কমিটি অবৈধ, অকার্যকর এবং বাদীর উপর প্রযোজ্য নয়।’ এরপর মামলাটি সুপ্রিমকোর্টের অ্যাপিলেট বেঞ্চে যায়। (সিপি নং ১৩২৬/২০১২)। মাননীয় আদালত ১০/০১/১০১৬ খ্রি. তারিখে তার রায়ে বলিষ্ঠ ভাষায় উল্লেখ করেন যে- ‘আমরা আরও মনে করি যে, একমাত্র আবেদনকারী মাওলানা আজিজুল হকের মৃত্যুর পর মামলার প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে তার উত্তরাধিকারী বা অন্য কোনো ব্যক্তির দ্বারা পিটিশনটি এগিয়ে নেওয়ার কোনো বিদ্যমান কারণ নেই। অতএব আবেদনটি খারিজ করা হলো।’ এই রায়ে শাইখুল হাদীস সাহেবের সন্তানদেরকে ‘থার্ড পার্টি’ উল্লেখ করে তাদের আবেদন নাকচ করা হয়েছে।
অপরদিকে জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া একটি ওয়াকফ সম্পত্তি হওয়ায় ১০/০২/২০০২ খ্রি. তারিখে ওয়াকফ প্রশাসনের নিকট প্রকৃত কমিটির চলমান ও প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি জনাব আলহাজ্ব আব্দুল মালেক সাহেব প্রকৃত কমিটিকে তালিকাভুক্তির আবেদন করেন। (এর মিস কেস নং ৩/২০০২)। তখন শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেবও নিজেকে জামি‘আর সভাপতি দাবী করে তাঁকে মুতাওয়াল্লী ঘোষণার আবেদন দাখিল করেন। অবশেষে ২১/০৭/২০০৭ খ্রি. তারিখে ওয়াকফ প্রশাসক বিস্তারিত তদন্ত সাপেক্ষে এবং দোতরফা বক্তব্য শুনে তৎকালীন সভাপতি হাজী আহমদ ফজলুর রহমানকে মুতাওয়াল্লী ঘোষণা করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট বৈধ কমিটিকে তালিকাভুক্তির ঘোষণা করেন এবং পূর্বের পরিচালনা কমিটিকেই জামি‘আ রাহমানিয়ার বৈধ পরিচালনা কমিটি বলে রায় দেন এবং ডিসি-ঢাকাকে পরপর দুইবার (২৯ জুন ২০০৮ ইং ও ২৮ এপ্রিল ২০০৯ ইং তারিখে) অবৈধ দখলদারদেকে উচ্ছেদের আদেশ প্রদান করেন। ডিসি কর্তৃক দুইবারই উচ্ছেদের জন্য দিন-তারিখ নির্ধারণ ও ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া সত্তে¡ও জবরদখলকারীরা আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক জোটবদ্ধতার ভিত্তিতে এবং মোহাম্মদপুরের তৎকালীন আওয়ামী লীগের এমপির সঙ্গে তাদের বিশেষ সখ্যতা ও দহরম-মহরমের সুবাদে তাকে ব্যবহার করে উচ্ছেদ অর্ডার দু’টো বাস্তবায়নে বেআইনিভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
উল্লেখ্য, ওয়াকফ প্রশাসনে উক্ত তালিকাভুক্তির বিরুদ্ধে দখলদার পক্ষ আপিল করার পর মামলাটি একপর্যায়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত যায়। (মামলা নং ২৬৬/২০১০)। অতঃপর আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ আপিলটি চূড়ান্তভাবে খারিজ করে দিয়ে উচ্ছেদ অর্ডার বহাল রাখে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
উপরের এই বিবরণ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুযায়ী দখলদার পক্ষ জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসার কোনো অর্থেই বৈধ কর্তৃপক্ষ নয়। আদালতের রায় অনুযায়ী এই দখলদারদের বহু আগেই উচ্ছেদ হওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা বিদ্যমান। কিন্তু দখলদার পক্ষ একদিকে 2005 খ্রি.-এর পর ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী জোটবদ্ধতা এবং পরবর্তীকালে 2018 সালে ফ্যাসিবাদের অন্যতম সহযোগী জাতীয় পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী জোটবদ্ধতাকে ব্যবহার করে এবং অপরদিকে মোহাম্মদপুরের তৎকালীন আওয়ামী লীগের এমপির বেআইনি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ২০২০ সাল পর্যন্ত আদালতের এই রায়কে বাস্তবায়ন হতে দেয়নি। কিন্তু বৈধ পরিচালনা কমিটি যথারীতি ওয়াকফ প্রশাসনে আইনানুযায়ী প্রতি তিন বছর পর নবায়নকৃত কমিটির তালিকা জমা দিয়েছে এবং বাৎসরিক খাজনাও পরিশোধ করে এসেছে, আইনি কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চালিয়ে এসেছে এবং দখলকৃত জামি‘আর ভবন থেকে দখলদারদের উচ্ছেদের যুক্তিযুক্ত দাবী থেকে কখনোই এক মুহূর্তের জন্য সরে আসেনি।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
প্রতি তিন বছর পরপর পরিচালনা কমিটি নবায়নের ধারাবাহিকতায় গত ১০/১২/২০২০ খ্রি. তারিখে বৈধ কমিটির বর্তমান সভাপতি ও মুতাওয়াল্লী জনাব আলহাজ্ব আব্দুর রহিম ওয়াকফ প্রশাসন বরাবর নবায়নকৃত পরিচালনা কমিটির তালিকাভুক্তির আবেদন করেন। এ সময় মোহাম্মদপুরের এমপি পরিবর্তন হলে নতুন এমপি আর আদালতের রায়ের উপর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ না করায় এবং আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়ায় জামি‘আ রাহমানিয়ার অবৈধ দখলদারিত্বের ব্যাপারে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতের উচ্ছেদ অর্ডারটি বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়।
অতঃপর পরিচালনা কমিটির উল্লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে ওয়াকফ প্রশাসক বৈধ কমিটিকে তালিকাভুক্ত করে এবং ঢাকা জেলার ডি সি সাহেবকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করত ওয়াকফ সম্পত্তি জামি‘আ রাহমানিয়া হতে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করত অনুমোদিত কমিটির বরাবরে মাদরাসার দখল হস্তান্তরের অনুরোধ করেন। ডি সি সাহেব একজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ ফোর্স নিয়ে বিগত ১৯ জুলাই ২০২১ খ্রি. মোতাবেক ৮ জিলহজ্ব মাদরাসা উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেন। ম্যাজিস্ট্রেট মাদরাসায় আসার পূর্বেই মাওলানা মাহফুজুল হকসহ অপরাপর দখলদাররা মাদরাসার সকল গেটে তালা মেরে মাদরাসা খালি করে চলে যায়। অতঃপর ওয়াকফ প্রশাসক কর্তৃক নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট তালাগুলো ভেঙে ওয়াকফ প্রশাসক কর্তৃক অনুমোদিত কমিটির নিকট মাদরাসার দখল হস্তান্তর করত দখল বুঝিয়ে দেন। বৈধ কমিটি অর্ধ শতাধিক মিডিয়াকর্মীর উপস্থিতিতে প্রেস ব্রিফিং করে মাদরাসার দখল বুঝে পেয়ে তারা সুষ্ঠুভাবে মাদরাসার যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন এবং দখলদারদের দখলকৃত সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির বিভিন্ন অংশের মেরামত কাজে এ যাবৎ কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় করেন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
উল্লিখিত আলোচনায় এ কথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, ২০২১ সালে জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ার বৈধ কর্তৃপক্ষ কোনো অবৈধ পন্থায় নয়; বরং আদালতের আদেশে এবং সম্পূর্ণ আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠানটির দখল বুঝে পেয়েছিল। বৈধ পরিচালনা পরিষদ ভবনটির দখল বুঝে পাওয়ার পর অপর পক্ষ তথা মাওলানা মাহফুজুল হক সাহেব গং এই ভবনটি পুনরায় ফিরে পেতে কোনো আইনি কর্তৃপক্ষের নিকট ক্লেইম করেননি। এটা খুব স্বাভাবিক বিষয় যে, তাদের দাবীমতে যদি তারা এই ভবনের বৈধ দাবীদার হয়ে থাকবেন তাহলে তারা উচ্ছেদিত হওয়ার পরও আইনি যে কোনো পন্থায় ভবনটি ফেরৎ পাওয়ার জন্য ক্লেইম করবেন। কিন্তু আমাদের জানামতে এমন কোনো ধরনের আবেদন বা দাবী তারা কোন লিগ্যাল কর্তৃপক্ষের কাছে করেননি। বরং এর বিপরীতে ২০২১ সালে জামি‘আ রাহমানিয়া থেকে উচ্ছেদিত হওয়ার পর মাওলানা মাহফুজুল হক বছিলা গ্রাম সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ‘জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এখনও সেটি বিদ্যমান রয়েছে। মাওলানা মামুনুল হকও জেলখানা থেকে বের হয়ে সেখানে যোগদান করেন। এ সময় জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া আয়োজিত সংবর্ধনা সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে মাওলানা মামুনুল হক- ‘এমন ভবন না থাকলেই ভালো, ভবন-টবন থাকলে অনেকের পায়ে তেল মালিশ করতে হয়। পাগড়িও নাই, বাঁধার ঝামেলাও নাই’- ইত্যাদি বলে বলে ভবিষ্যতে আর জামি‘আ রাহমানিয়া জবরদখল না করার স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন এবং ইতোপূর্বে যে দীর্ঘ একটা সময় তারা আইনানুগভাবে নয় বরং শুধুই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এবং বিভিন্ন যোগসাজশের মাধ্যমে এই মাদরাসাটি অবৈধভাবে দখলে রেখেছিলেন- প্রকারান্তরে তারও স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। অপরদিকে আমাদের জানামতে মাওলানা মাহফুজুল হক সাহেবও বছিলাবাসী অনেকের নিকট আর কোনোদিন জামি‘আ রাহমানিয়া মাদরাসায় না-যাওয়ার স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। বছিলাবাসী এই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সহযোগিতাপ্রবণ হয়ে তাকে ছাত্র নিয়ে বসার ব্যবস্থা করে দেন। সুতরাং তাদের নতুন নামে প্রতিষ্ঠান করা, জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসাকে আইনিভাবে নিজেদের বলে দাবী না করা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে এই মাদরাসায় পুনরায় ফিরে না আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তারা এই প্রতিষ্ঠানের বৈধ কর্তৃপক্ষ নন এবং কখনো ছিলেন না। এর বিপরীতে জামি‘আর বৈধ কর্তৃপক্ষ কোনোকালেই আইনিভাবে প্রতিষ্ঠানটির দাবী থেকে পিছু হটেননি এবং পরিশেষে আদালত চূড়ান্ত রায়ে তাদেরকে জামি‘আ রাহমানিয়ার বৈধ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে।
প্রিয় সাংবাদিক ভাইয়েরা!
এত কিছুর পরও যখন ৫ আগস্ট সরকার পতনের সাথে সাথে উল্লিখিত মাওলানা মাহফুজুল হক ও মাওলানা মামুনুল হক গং বাংলাদেশের মহামান্য আদালত, ওয়াকফ প্রশাসন, ডিসি ও ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ লঙ্ঘন করে এবং জাতির নিকট কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করে সন্ত্রাসী কায়দায় মাদরাসায় ঢুকে অবস্থান নিল, তখন প্রথমত মাওলানা মাহফুজুল হক গং দাবী করেন যে, তাদের অজান্তে তাদের অনুসারীরা মাদরাসাটি দখল করেছে এবং এ ব্যাপারে তারা ‘খুবই বিব্রত’। কিন্তু এর অব্যবহিত পরেই তারা এই দখল টেকানোর জন্য সর্বাত্মক দৌড়ঝাঁপ শুরু করায় এবং অনুসারীদের এই বেআইনি জবরদখলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এটা শতভাগ স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই দখলকাণ্ডের সম্পূর্ণ দায় তারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
এ সময় মাদরাসার বৈধ কমিটি হানাহানির পথে না গিয়ে পুনরায় আইনি পন্থা গ্রহণ করেন। মাদরাসার বৈধ কর্তৃপক্ষ- বর্তমান মুতাওয়াল্লী ও সভাপতির নির্দেশে থানায় জি.ডি. করেন এবং যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি ওয়াকফ এস্টেটের আওতাধীন, এজন্য গত ১৮ আগস্ট ২০২৪ খ্রি. তারিখে দরখাস্ত মারফত অবৈধ দখলের বিষয়টি ওয়াকফ প্রশাসককে অবহিত করেন এবং অতি দ্রæত ডিসি-কে উচ্ছেদ আদেশ প্রদানের মাধ্যমে দখলদারদের উচ্ছেদ দাবি করেন।
কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, ওয়াকফ প্রশাসক জামি‘আ রাহমানিয়ার বর্তমান মুতাওয়াল্লী ও সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুর রহিমের দরখাস্ত আমলে না নিয়ে উল্টো দখলদারদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন। অর্থাৎ অবৈধ দখলদাররা জবরদখলের পর মাওঃ প্রঃ গিয়াস উদ্দিনকে সভাপতি দাবী করে তথাকথিত একটি কমিটি তালিকাভুক্ত করার জন্য সম্পূর্ণ অসত্য তথ্য দিয়ে ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন দাখিল করে। ওয়াকফ প্রশাসক একদিকে দখলদারদের এই কমিটিকে বেআইনিভাবে অনুমোদন দেন, অন্যদিকে মাত্র তিন মাস আগে ২১ মে ২০২৪ খ্রি. তারিখে বর্তমান মুতাওয়াল্লী ও সভাপতি আলহাজ¦ আব্দুর রহিমের আবেদনে যে কমিটিকে ৩ বছরের জন্য যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল; তাকে কোনো নোটিশ না দিয়ে বা অবগত না করেই সেই কমিটি বাতিল করে দেন এবং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করারও কোনো সুযোগ দেননি। এ যেন ডাকাতদল কর্তৃক বাড়ি দখলের পর ডাকাতদলকে উচ্ছেদ না করে এবং বাড়ির মালিককে বাড়িতে পাওয়া যায়নি দাবি করে উল্টো ডাকাতদলকেই বৈধতা দান করে ঘরের মালিককে উচ্ছেদের নামান্তর!
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
ওয়াকফ প্রশাসক যেই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে মাওলানা মাহফুজুল হকদের আবেদনকৃত তথাকথিত বানোয়াট কমিটির অনুমোদন দিয়েছে তার বাস্তবতা দেখুন।-
(ক) তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে- ‘মূল মুতাওয়াল্লী বরাবর নোটিশ জারি করি।’
বাস্তবতা: এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অসত্য কথা। কারণ মুতাওয়াল্লী সাহেবের কাছে ওয়াকফ প্রশাসকের পক্ষ থেকে এ প্রসঙ্গে কোনও নোটিশ আসেনি এবং মুতাওয়াল্লীকে নোটিশ করার দাবীর পক্ষে ওয়াফক প্রশাসকের কাছে কোনো প্রমাণ নেই।
(খ) বলা হয়েছে- ‘তদন্তকালে মাওলানা গিয়াস উদ্দিন ও তার কমিটি উপস্থিত থাকলেও আলহাজ্ব আব্দুর রহিমকে উপস্থিত পাওয়া যায় নাই।’
বাস্তবতা: কথাটি হাস্যকর ও অসত্য। কারণ মুতাওয়াল্লীকে তো নোটিশই দেওয়া হয়নি, তাহলে তদন্ত হবে এটা তিনি কীভাবে জানবেন? তাছাড়া ওয়াকফ প্রশাসককে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে, মাদরাসাটি জবরদখলকারীদের কব্জায় রয়েছে এবং সেখানে তারা গুণ্ডাপাণ্ডা নিয়ে অবস্থান করছে, তাহলে মুতাওয়াল্লী ও তার কমিটি সেখানে কীভাবে প্রবেশ করবে? ওয়াকফ প্রশাসককে অবৈধ দখলের সংবাদ জানানোর পরও তিনি যদি দখলদারদেরকে উচ্ছেদ না করেই সেখানে কোনো নোটিশ পাঠিয়ে থাকেন তাহলে সেটা তো অবৈধ দখলদাররা পেয়েছে; মুতাওয়াল্লীর পাওয়ার সুযোগ কোথায়? সুতরাং ওয়াকফ প্রশাসকের এই নোটিশ ও তদন্ত প্রতিবেদন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও হাস্যকর।
(গ) বলা হয়েছে- ‘আলহাজ্ব আব্দুর রহিমকে উপস্থিত না পাওয়ায় তার বক্তব্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।’
বাস্তবতা: এর উত্তর আগেই দেওয়া হয়েছে যে, মুতাওয়াল্লী আব্দুর রহিম সাহেব ও তার কমিটিকে এ প্রসঙ্গে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। মুতাওয়াল্লী কিংবা তার কমিটি নোটিশ পেয়েছে মর্মে ওয়াকফ প্রশাসকের নিকট কোনো প্রমাণ থাকলে তা পেশ করার অনুরোধ করা হচ্ছে। মুতাওয়াল্লীকে নোটিশ না পৌঁছানো সত্তে¡ও তিনি উপস্থিত না থাকায় তার বক্তব্য গ্রহণ করা হয় নাই- এটা কোনো বিজ্ঞ লোকের কথা হতে পারে না।
(ঘ) প্রঃ মাওঃ গিয়াস উদ্দিন-এর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত কয়েক বছর যাবত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একটি মহল মাদরাসাটি জোরপূর্বক দখলে রেখেছিল।
বাস্তবতা: অথচ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে ২০২১ সালের ১৯ জুলাই ওয়াকফ প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সম্পূর্ণ খালি ভবন বৈধ পরিচালনা কমিটিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কাজেই মাওলানা গিয়াস উদ্দিন সাহেবের বক্তব্যটি সম্পূর্ণ অসত্য। বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সেই উদ্ধার অভিযানের হাজারো প্রত্যক্ষদর্শী এখনও বিদ্যমান আছে।
(ঙ) মাওলানা গিয়াস উদ্দিন স্বাক্ষরিত ওয়াকফ প্রশাসক বরাবর আবেদনপত্রে বলা হয়েছে- ৫ আগস্ট ২০২৪ খ্রি. তারিখ সরকার পরিবর্তিত হলে পরিচালনা পরিষদ নাকি মাদরাসাটি অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রেখে আত্মগোপনে চলে গিয়েছে।
বাস্তবতা: এরূপ নির্জলা অসত্য বয়ান সংবলিত আবেদনপত্র কী করে সমাজের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি দাখিল করতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। জবরদখলের সময় উক্ত ভবনে স্বয়ং প্রিন্সিপ্যাল (যিনি পরিচালনা পরিষদের সদস্য বটে) ও ভাইস প্রিন্সিপ্যালসহ বহু শিক্ষক-কর্মচারী এবং মক্তব-হিফজখানা ও কিতাবখানার শতশত শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। সুতরাং তারা কখন কীভাবে আত্মগোপনে চলে গেলেন? দখলদারগণ যখন তাদেরকে অস্ত্রের মুখে বের করে দিল তখন থেকে তারা মোহাম্মদপুরে বছিলা এলাকায় স্বপ্নধারা হাউজিং-এর আবরার মাদরাসার মসজিদে অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এখানে ছাত্রদের নিয়ে নিয়মিত ক্লাসও পরিচালিত হচ্ছে। সুতরাং কমিটির কিংবা দায়িত্বশীলদের একজনেরও আত্মগোপনে যাওয়ার দাবী কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।
(চ) ওয়াকফ প্রশাসকের তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, তদন্তস্থলে উপস্থিত হয়ে তদন্তকারীগণ মাওলানা গিয়াস উদ্দিনকে পেয়েছেন।
বাস্তবতা: একথার সত্যতা আল্লাহই ভালো জানেন যে, ওয়াকফ প্রশাসনের কেউ ঘটনাস্থলে আদৌ গিয়েছিল কিনা কিংবা মাওলানা গিয়াস উদ্দিন সাহেবকে সেখানে পেয়েছিল কিনা? আমাদের জানামতে কথাটি সম্পূর্ণ অসত্য। সুতরাং মাওলানা গিয়াস উদ্দিন সাহেবের আবেদন যেমন আগা-গোড়া অসত্য ও বানোয়াট, তেমনি ওয়াকফ প্রশাসকের তদন্ত রিপোর্ট এবং অনুমোদনও চরম পর্যায়ের জালিয়াতি।
(ছ) কথিত তদন্ত রিপোর্টে প্রঃ মাওঃ গিয়াস উদ্দিন-এর এই বক্তব্যও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘গত কয়েক বছর যাবৎ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একটি মহল জোরপূর্বক মাদরাসাটি দখল করে রেখেছিল।’
বাস্তবতা: এটাও সম্পূর্ণ অসত্য একটা দাবি। এই কমিটি পরিচালিত মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ কোনও দল করে না এবং কারও দালালীও করে না; আওয়ামী লীগের দালালীর তো প্রশ্নই উঠে না। বরং এই প্রতিষ্ঠানের সকল ছাত্র-শিক্ষকের জন্য কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ। ইতিপূর্বে আমরা বিস্তারিত উল্লেখ করেছি যে, সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ায় এই ভবনটি ২০২১ সালে বৈধ কমিটি হাতে পেয়েছিল। এর বিপরীতে দখলদাররা বিশটি বছর আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সাথে লিয়াজো মেইনটেইন করে ভবনটি জবরদখল করে রেখেছিল।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
এমতাবস্থায় আমাদের দাবিগুলো এই-
১. মাওলানা মাহফুজুল হক গং যেভাবে বেআইনি পন্থায় জামি‘আর ভবন জবরদখল করেছে, তার প্রতিকারে নিজ দায়িত্বে ভবন ত্যাগ করে প্রকৃত কর্তৃপক্ষের কাছে চাবি বুঝিয়ে দিতে হবে। এতে আলেম হিসেবে তাদের মর্যাদা কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।
২. ওয়াকফ প্রশাসককে তার জারি করা অবাস্তব, অন্যায্য এবং বেআইনি নোটিশ বাতিল করতে হবে এবং প্রকৃত কমিটিকে যথারীতি বহাল রাখতে হবে। দখলদাররা স্বেচ্ছায় ভবন ত্যাগ না করলে ডিসির মাধ্যমে তাদের উচ্ছেদ করত প্রতিষ্ঠানটি তার প্রকৃত কমিটিকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
৩. ভবন জবরদখলে যেসব লুটপাট, ভাঙচুর এবং সম্পদ ও নগদ অর্থ তছরুফ করা হয়েছে, সরকারকে তার প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য, অন্যান্য জরুরী সামান-পত্রের পাশাপাশি নগদ ৮০০,০০০/- (আট লাখ) টাকা -যা শিক্ষকদের বেতনের জন্য ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল- দখলদাররা তছরুফ করেছে।
৪. মাননীয় আদালতের কাছে আমরা ন্যায় বিচার প্রার্থনা করি। জবরদখলকারী এবং বেআইনিভাবে জারি করা ওয়াকফ প্রশাসনের নোটিশ বিষয়ে আদালত যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আমরা আশাবাদী।
৫. সরকারের পক্ষে মাননীয় ধর্ম উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন যে, ওয়াকফ প্রশাসনের দুর্নীতি বিষয়ে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। আমরা এই পদক্ষেপ তরান্বিত করার দাবী জানাই এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কেউ এই দুর্নীতিতে জড়িত থাকলে সে বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলেও আশা রাখি। আমরা মনে করি, সাধারণ মানুষ জনশ্রæতি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীলদের জন্য ফ্যাক্ট চেক না করে শুধু জনশ্রুতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনোভাবেই শোভনীয় নয়।
৬. মাননীয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে আমাদের দাবী, গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে জামি‘আর ভবনে দখলকাণ্ড চলাকালে আমরা প্রশাসনের সহায়তা চেয়েও ট্রুপস স্বল্পতার অজুহাতে সহযোগিতা পাইনি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন এবং এর প্রতিকারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করি।
আর ইনসাফপ্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ ও জনসাধারণের নিকট আমাদের প্রত্যাশা- আপনারা জনশ্রুতি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে এবং দখলদারদের গুজবে কান না দিয়ে বাস্তবতা জানার চেষ্টা করুন। কারও বাহ্যিক ভদ্রতা এবং মুখোশ দেখে ভুলে যাবেন না যে, এমন ব্যক্তিও প্রতিহিংসা চরিতার্থকারী, চরম জুলুমবাজ ও ভয়ঙ্কর জবরদখলকারী হয়ে উঠতে পারে! জামি‘আ রাহমানিয়া প্রসঙ্গে ঠিক এই জুলুমটাই ঘটেছে দখলদারদের দ্বারা। শত শত ছাত্র শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি ছাত্রাবাস হারিয়ে এখন কষ্টকর অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করছে। ছাত্রদের এই কষ্টে ফেলার কোনো ধরনের আইনি বা নৈতিক বৈধতা নেই। আমাদের বিশ্বাস, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিনিময়ে ০৫ আগস্টে অর্জিত নতুন স্বাধীন দেশ কোনো নব্য বৈষম্যকে প্রশ্রয় দিবে না। এই রক্তভেজা অভ্যুত্থান এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে সংঘটিত হয়েছে; যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে ইনসাফ, অবসান ঘটবে সকল রাজনৈতিক দখলদারিত্ব ও জুলুমের। সুতরাং এই জবরদখল ও অন্যায়ের প্রতিকারে আপনারা নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবেন বলে আমরা আশা করি।